জাদুবিদ্যা মহাবিদ্যা, করতে হবে লেখাপড়া


কিছু দিন আগেই হয়ে গেলো আন্তর্জাতিক জাদুবিদ্যা দিবস৷ কিন্তু জাদুকর হিসেবে পেশা বানানো সম্ভব কি এখন? হলে, কীভাবে?
কার্ল জার মেইন বলেছিলেন, 'একমাত্র ম্যাজিকই হলো সত্‍ পেশা৷ একজন ম্যাজিশিয়ান প্রথমেই প্রতিজ্ঞা করেন তিনি আপনাকে ঠকাবেন এবং সত্যি-সত্যিই তিনি সেটা করেন৷' কে এই কার্ল জার মেইন? আসল নাম চার্লল ম্যাটমুয়েলার৷ একই সঙ্গে ল'ইয়ার এবং বিখ্যাত ম্যাজিশিয়ান৷ জন্ম সূত্রে আমেরিকান এই ভদ্রলোক ম্যাজিক দেখাতেন 'জার নেইন দ্য উইজার্ড' নামে৷ শ্রীযুক্ত জারমেইন-এর বক্তব্যের সত্যতা যে একশো শতাংশ, তাতে কোনও সন্দেহ নেই৷ অতএব, আপনি যদি পেশাদার হিসেবে সত্‍ থাকতে চান, তাহলে ম্যাজিককে পেশা হিসেবে নিতেই পারেন৷ কিন্ত্ত এইখানে একটা প্রশ্ন তৈরি হতে পারে যে ম্যাজিক কি শুধু লোককে ঠকানো? প্রতারণা করা? কিছুটা তো বটেই৷ কিন্ত্ত এর বাইরে ম্যাজিক হলো একটা বিশুদ্ধ শিল্প৷ পারফর্মিং আর্ট৷ যে-ভাবে মঞ্চে একজন গায়ক কিংবা বাদক অথবা নট তাঁর শিল্প প্রদর্শন করে শ্রোতা-দর্শককে মুগ্ধ করেন, একজন ম্যাজিশিয়ান বা জাদুকরও তাঁর ট্রিক দেখিয়ে বা ইলিউশন বা ভ্রম সৃষ্টি করে দর্শকের তারিফ এবং মুগ্ধতা অর্জন করে নিতে পারেন৷ বিজ্ঞান এবং কৌশলকে নির্ভর করে দর্শককে সম্মোহিত করে রাখাই হলো একজন জাদুকরের কাজ৷ 

কিন্ত্ত একজন দক্ষ স্টেজ ম্যাজিশিয়ান বা ইলিউশনিস্ট হওয়া যে খুব সহজ কাজ, তা একেবারেই নয়৷ ঠিক যেভাবে একজন পেন্টার ক্রমশ দক্ষ-শিল্পীতে রূপান্তরিত হন, একইভাবে একজন আনকোরা নতুন জাদুকরও রূপান্তরিত হন জাদুসম্রাটে৷ একদিনে হয় না৷ দক্ষতা অর্জন করতে হয় এবং এর পাশাপাশি প্রয়োজন প্রতিভার৷ প্রতিভা না থাকলে যেমন ছবি আঁকতে জানলেই পিকাসো হওয়া যায় না, তেমনই সামান্য ম্যাজিক জানলেই হুডিনি হয়ে ওঠাও সম্ভব নয়৷ ম্যাজিকের প্রতি ডেডিকেশন বা আত্ম-নিবেদন থাকলেই আপনিই গড়ে উঠবে আত্মবিশ্বাস এবং সৃজনশীলতা৷ ম্যাজিক-শিল্পের প্রতি ডিভোশন প্রয়োজন- এই কথা বার-বার বলে এসেছেন প্রবাদ-প্রতিম জাদুকরেরা তাঁদের অনুজদের প্রতি৷ 

একটা সময় জাদুবিদ্যা শিখতে চাইলেই শেখা যেতো না৷ কারণ, ম্যাজিক আজও এমন গুপ্ত এক বিদ্যা যা চট করে কেউ কাউকে শেখাতে চান না৷ এমনকী আজও চিকিত্‍সকদের মতো ম্যাজিশিয়ানদেরও শপথ বা 'ওথ' নিতে হয়৷ 'একজন জাদুকর হিসেবে আমি শপথ করছি কোনও অ-জাদুকরের কাছে জাদু-কৌশল প্রকাশ করবো না৷' অনেকেই মনে করেন জাদু-কৌশল ফাঁস হয়ে গেলে আর্ট-ফর্ম হিসেবে ম্যাজিকের কোনও কদরই আর থাকবে না৷ 

কিন্ত্ত, অনেক পরে প্রচুর জাদু-শিক্ষার বই বাজারে আসায় এবং হালে ডিভিডি এবং ইউডিউবের দৌলতে অনেক ট্রিকই জেনে নিয়েছেন সাধারণ মানুষ এবং উত্‍সাহী তরুণ, যাঁরা জাদুকর হতে ইচ্ছুক৷ ১৫৮৪ সালে জাদু-কৌশল ফাঁস করে দেওয়া যে-বিখ্যাত গ্রন্থটি বাজারে বেরোয় সেটির রচয়িতা এক ইংরেজ৷ নাম রেগিন্যাল্ড স্কট৷ তিনি যে বইটি প্রকাশ করেন, তার নাম 'দ্য ডিসকভারি অফ উইচক্রাফ্ট'৷ এর পরে ধীরে-ধীরে প্রকাশিত হয় 'আর্ট অফ কনজিওরিং' (১৬১৪) এবং 'আর্ট অফ জাগলারি' (১৬৭৫)৷ 

কিন্ত্ত এতদসত্ত্বেও দেখা গেল ম্যাজিক-শিল্পের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ এতোটুকু কমে যায়নি৷ ফলে, জাদু-কৌশল ফাঁস হয়ে গেলেও আর্ট ফর্ম হিসেবে ম্যাজিকের কদর যে কমবে না, এটা অনেকেই বুঝতে শিখলেন৷ ম্যাজিশিয়ানরাও বুঝলেন কৌশলের চেয়েও বড়ো ব্যাপার হলো পরিবেশন যা শেখানো যায় না৷ প্রতিভা দিয়ে আয়ত্ত্ব করতে হয়৷ একই খেলা অনেক জাদুকরই দেখান তবু পিসি সরকার কেন এখনও জনপ্রিয়তার শীর্ষে? কারণ, তাঁর শোম্যানশিপ৷ এই শোম্যানশিপ অর্জন করতে হয় অভিজ্ঞতা, অনুশীলন এবং নিজস্ব প্রতিভার জোরে৷ তখন সেই একই ট্রিক দর্শকের সামনে উপস্থাপিত হয় নব-কলেবরে৷ দর্শক বুঝতেই পারেন না, পুরনো খেলাই তাঁরা দেখছেন৷ এখন কোন চেহারায়, কীভাবে পুরনো মদ নতুন বোতলে ভরতে হবে সেটাই হলো ম্যাজিক-শিল্পের মূল কথা৷ 

এখন প্রশ্ন হলো, আপনার উত্‍সাহ, ডেডিকেশন, মোটিভেশন সব আছে, আপনি কিছুতেই এগোতে পারছেন না৷ তখন কী করণীয়? অনেকেই গোড়ার দিকে ম্যাজিক দেখানো একটা 'হবি' বা নেশার স্তরে রেখে দেন৷ এই স্তরে ম্যাজিককে রেখে এগোনোই ভালো৷ অনেকটা এগিয়ে গেলে, নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস যখন তুঙ্গে উঠবে, তখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে পেশা বা প্রফেশন হিসেবে ম্যাজিককে নেবেন কি না! বর্তমানের অনেক পেশাদার জাদুকরই কিন্ত্ত গোড়ায় পেশাদার ছিলেন না, নেশায় ম্যাজিক দেখাতেন৷ 

ম্যাজিক এমন একটা শিল্প যেখানে রোজ নতুন-নতুন জিনিস শিখতে হয়৷ এই শেখার জন্য, গাইডেন্স পাওয়ার জন্য 'ম্যাজিক ক্লাব' বা 'ম্যাজিক সার্কল'-এর সদস্য হয়ে যাওয়াটাই শ্রেয়৷ এখান যুক্ত থাকলে পেশাদার এবং প্রবীণ জাদুকরদের কাছ থেকে টিপস পাওয়া সহজ৷ তাঁদের সঙ্গে-সঙ্গে থাকলেও স্টেজ পারফরম্যান্সের অনেক দিক বোঝা সহজ হয়ে যায়৷ পৃথিবীর সব চেয়ে বৃহত্‍ এমন ক্লাবটির নাম হলো, 'ইন্টারন্যাশনাল ব্রাদারহুড অফ ম্যাজিশিয়ানস'৷ প্রাচীনতম সংস্থাটি হলো 'সোসাইটি অফ অ্যামেরিকান ম্যাজিশিয়ানস', যার সদস্য ছিলেন স্বয়ং হুডিনি৷ এখন এ-সবই বিদেশে৷ দেশে এবং আপনার ঘরের কাছে এমন ক্লাব কি নেই? অবশ্যই আছে৷ ইন্টারনেট জানাচ্ছে 'চন্দননগর জাদুকর চক্র' এমনই একটি ক্লাব৷ আরও আছে, খোঁজ খবর করলেই তার হদিশ পাওয়া কিছু কঠিন নয়৷ 
জাদুবিদ্যা মহাবিদ্যা, করতে হবে লেখাপড়া জাদুবিদ্যা মহাবিদ্যা, করতে হবে লেখাপড়া Reviewed by Thailand Life on 11:36 PM Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.