নেট-পর্নের আসক্তিতে হারাচ্ছে শহরের শৈশব



দিনরাত স্মার্টফোন নিয়েই বুঁদ থাকত ক্লাস সেভেনের অঙ্কন মল্লিক৷ ছেলের নেট-সার্ফিং দেখে বিরক্ত হতেন বাবা-মা৷ একদিন বুঝতে পারলেন, নিছক ইন্টারনেট ব্যবহার করাই নয়৷ ছেলে সারা দিন মজে থাকে পর্নোগ্রাফির হাজারো সাইট নিয়ে৷ 

'স্মার্টফোন কেড়ে নেওয়ার প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ভয়ঙ্কর,' মন্তব্য অঙ্কনের বাবার৷ জানাচ্ছেন, রেগে গিয়ে জিনিসপত্র ভাঙচুর থেকে শুরু করে মা-বাবার গায়ে হাত তোলা- কোনওটাই বাদ দেয়নি তাঁদের ছেলে৷ উদ্বিগ্ন অভিভাবক তাঁকে ইনস্টিটিউট অফ সাইকিয়াট্রি (আইওপি)-তে নিয়ে এলে, চিকিত্‍সকরা বুঝতে পারেন, তামাক-মাদকের মতোই ইন্টারনেট আর পর্নোগ্রাফির আসক্তি গ্রাস করেছে অঙ্কনকে৷ এবং তার মাত্রা এতটাই বেশি যে আইওপি-তে মাসদেড়েক ভর্তি রেখে চিকিত্‍সা করতে হয়েছিল ওই স্কুলপড়ুয়ার৷ 

পাভলভের মনোরোগ আউটডোরের চিকিত্‍সকরা চমকে গিয়েছিলেন ক্লাস ফোরের শান্তনীড় রায়কে দেখে৷ এই বয়সেই সে শুধু পর্নোগ্রাফি সাইটের পোকা-ই নয়, ন' বছর বয়সেই সে হস্তমৈথুনের অভ্যাস রপ্ত করে ফেলেছে! বয়ঃসন্ধির দোরগোড়ায় দাঁড়ানো ওই কিশোরের দৈনন্দিন অভ্যাস দেখে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি, নেট-পর্নোর প্রতি নিছক ভালো লাগা নয়, রীতিমতো আসক্তি বা অ্যাডিকশনের শিকার হয়ে পড়েছে শান্তনীড়৷ বাবার কমপিউটারে তার হাত দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ায় সে অসুস্থও হয়ে পড়ে৷ উইথড্রয়াল সিন্ড্রোম সামলাতে কাউন্সেলিং আর ওষুধ দিয়ে চিকিত্‍সা চালাতে হয় তার৷ 

ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপে অহোরাত্র মজে থাকত ক্লাস নাইনের অহনা মজুমদার৷ স্মার্টফোনটা বাবা কেড়ে নিতে পড়াশোনা বন্ধ, এমনকি মা-বাবার সঙ্গে কথাবার্তা বলাও বন্ধ করে দিয়েছিল কিশোরী৷ মাস ঘোরার পর বাবার সন্দেহ হয়, মেয়ে অবসাদের ডুবে যাচ্ছে না তো! মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গেলে, ডাক্তারবাবু জানান, বাবার সন্দেহ এক্কেবারে ঠিক৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় এতটাই আসক্ত হয়ে পড়েছিল অহনা যে তা বন্ধ করে দেওয়ার পর উইথড্রয়াল সিন্ড্রোমের জেরে বড়সড় মানসিক ধাক্কা খেয়েছে নবম শ্রেণির ওই ছাত্রী৷ 

মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হু-হু করে বাড়ছে 'অঙ্কন-শান্তনীড়-অহনা'দের সংখ্যা৷ প্রাইভেট ক্লিনিক হোক বা সরকারি হাসপাতালের আউটডোর- সর্বত্রই নেট-পর্নোর আসক্তির জেরে মনোরোগী হয়ে যাওয়া কিশোর-কিশোরীর ভিড় নিত্য বেড়ে চলেছে৷ চিকিত্‍সকদের কাছে এমন গোত্রের 'বিহেভেরিয়াল ডিজওর্ডার'-এর রোগী একেবারেই নতুন৷ ফলে তাদের চিকিত্‍সা করতেও একটু বেগ পেতে হচ্ছে বিশেষজ্ঞদের৷ এখনও এ নিয়ে এ শহরে কোনও সমীক্ষা হয়নি বটে, কিন্ত্ত চিকিত্‍সকদের অভিজ্ঞতা বলছে, স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে এই রোগের হার বেড়েই চলেছে গত দেড়-দু' বছরে৷ তারা শুধু আসক্তই হচ্ছে না, পর্নোগ্রাফির মোড়কে ধর্ষণজাতীয় ভিজ্যুয়াল তাদের অগোচরেই মনে অপরাধমনস্কতার বীজ বপণ করে চলেছে৷ 

আইওপির অধিকর্তা প্রদীপ সাহার বক্তব্য, 'অঙ্কনকে ভর্তি করে নেওয়ার আগেই বুঝতে পেরেছিলাম, ছেলেটি অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার (ওএসডি)-এ আক্রান্ত৷ চিকিত্‍সায় দেরি হলে ওর ভবিষ্যতটাই বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারত৷' তিনি জানান, আইওপি-র ডিঅ্যাডিকশন ক্লিনিকে মাদক, তামাক, মদ ইত্যাদিতে আসক্ত রোগীর ভিড়ে ইদানীং নয়া সংযোজন নেট-পর্নো অ্যাডিকশনের শিকার কিশোর-কিশোরীরা৷ এবং এদের সংখ্যাটাও নেহাত মন্দ নয়৷ 'ক্লিনিকে বিভিন্ন আসক্তির যে সব রোগী আসে, তাদের মধ্যে নেট-পর্নোয় আসক্তদের হার ৮-১০ শতাংশ,' মন্তব্য প্রদীপবাবুর৷ 

ন্যাশনালের মনোরোগ বিভাগের প্রধান শর্মিলা সরকার জানান, এই প্রবণতা তাঁরাও লক্ষ্য করেছেন৷ তাঁর কথায়, 'সম্প্রতি দু'টি সমীক্ষা পড়েছি দু'টি জার্নালে৷ একটিতে বলা হচ্ছে, নেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৫-১০ শতাংশ মানুষ আসক্তির শিকার যাঁদের চিকিত্‍সা প্রয়োজন৷ অন্যটিতে বলা হচ্ছে, গুগলে সার্চ করা যাবতীয় সাইটের মধ্যে সিংহভাগই পর্নো সংক্রান্ত৷ বিষয় দু'টি যে নেহাত তাত্ত্বিক নয়, তা আউটডোরে আজকাল বুঝতে পারি স্পষ্ট৷ এরা প্রত্যেকেই কমবেশি পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারের সমস্যায় ভোগে৷' তিনি জানান, আর পাঁচটা আসক্তির যা যা লক্ষণ-উপসর্গ, নেট-পর্নো আসক্তির ক্ষেত্রেও ঠিক তা-ই হয়৷ অ্যাডিকশনের যে প্রধান দু'টি চরিত্র, সেই উইথড্রয়াল সিন্ড্রোম এবং টলারেন্স (ধীরে ধীরে বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা)-- দুটোই দেখা যাচ্ছে নেট-পর্নোয় আসক্ত রোগীকূলের মধ্যে৷
 


চিকিত্‍সকদের অভিজ্ঞতা, আচমকা নেট-পর্নো থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হলে আসক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে পালস রেট বেড়ে যাওয়া, উদ্বেগ, বুক ধড়ফড়ানি বেড়ে যায়, মেজাজ হয়ে যায় তিরিক্ষে, অস্থির৷ এই আসক্তি র হার আজকাল এতটাই ঊর্ধ্বগামী যে বিভিন্ন ডিঅ্যাডিকশন ক্লিনিকের মধ্যে সুপার-স্পেশ্যালিটি স্তরে নেট ডিঅ্যাডিকশন ক্লিনিকও তৈরির চল শুরু হয়েছে৷ কলকাতায় যে একমাত্র কেন্দ্রটি রয়েছে সেই টার্নস্টোন গ্লোবালের অধিকর্তা সত্যম দে বলেন, 'গত ছ' মাসে দেখছি এমন রোগীর সংখ্যা নিয়মিত বেড়ে চলেছে৷ দৈনিক ৫০-৬০টি ফোন পাই আমরা৷ শহরের অনেক মনোরোগ বিশেষজ্ঞও আমাদের কাছে বহু রোগীকে রেফার করেন৷' মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রাম কিংবা কেদাররঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিজ্ঞতাও আলাদা নয়৷ 

জয়রঞ্জনবাবু বলেন, 'কয়েক বছর আগেও এমন রোগী ন'মাসে-ছ'মাসে পেতাম৷ এখন প্রায় প্রতিদিনই পাই নেট-পর্নোয় আসক্ত কিশোর-কিশোরীদের৷' কেদাররঞ্জনবাবু জানান, এই প্রবণতা আসলে এমন একটা মনোবিকার যে এর শিকার ব্যক্তি সব জেনে, সব বুঝেও এটা না-করে থাকতে পারে না৷ তাই ডাক্তারি শাস্ত্রে একে অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডারের অন্তর্গত ইমপালস কন্ট্রোল ডিজঅর্ডার বলে বিবেচনা করা হয়৷ তাঁর বক্তব্য, 'মনোরোগের শিকার কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ৩০-৫০ শতাংশই নেট-পর্নোর শিকার৷ এই প্রবণতা এতটাই ঊর্ধ্বগামী যে আমরা যে বইকে বাইবেল মানি, সেই ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্যাল ম্যানুয়াল ফর মেন্টাল ডিজঅর্ডার বইয়ের পঞ্চম তথা সাম্প্রতিকতম সংস্করণেও নেট-পর্নো আসক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত অধ্যায় আত্মপ্রকাশ করেছে৷' (সব মানসিক রোগীর নাম পরিবর্তিত)
নেট-পর্নের আসক্তিতে হারাচ্ছে শহরের শৈশব নেট-পর্নের আসক্তিতে হারাচ্ছে শহরের শৈশব Reviewed by Thailand Life on 10:04 PM Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.