আদৌ কি কখনও দুর্নীতিমুক্ত হতে পারবে ফিফা?

তিনি ওয়ার্ল্ড অ্যান্টি-ডোপিং এজেন্সির প্রাক্তন সভাপতি, অলিম্পিক ব্রডকাস্টিং সার্ভিসেস-এর বর্তমান সভাপতি এবং ক্যানাডার প্রতিনিধিত্ব করে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির দীর্ঘকালের সদস্য৷ তিনি রিচার্ড পাউন্ড৷ তিনি সম্প্রতি লুসানে বেশ একটা কৌতূহলোদ্দীপক ইঙ্গিত দিয়েছেন- ফিফার এই কেলেঙ্কারি বেনজির৷ এর পর এই সংস্থাকে মানুষের আস্থা ফিরে পেতে হলে পাহাড়প্রমাণ বাধা টপকাতে হবে৷ একদিকে ললিত মোদী ভারতীয় ক্রিকেট দুনিয়ার উপর একের পর এক কামান দেগে চলেছেন, অন্যদিকে ফিফা কর্মকর্তারা যে ভাবে মার্কিন এফবিআইয়ের নজরে পড়েছেন তাতে বেশ বলা যায় যে, আগামী কিছুকাল ক্রীড়াজগতের প্রশাসন আর নৈতিকতা নিয়ে চর্চা চলতেই থাকবে৷ এর মধ্যে আবার অসাধারণ তদন্তমূলক সাংবাদিকতার ফলে ফিফার মতো অস্বচ্ছ কিছু সংস্থার বহু গোপন দলিল জনসমক্ষে ফাঁস হওয়ায় ঘৃতাহুতি হয়েছে৷ 



২০১০ সালে বহু প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠে কাতার ২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করার অনুমোদন পেয়েছে৷ কিন্তু কী ভাবে সেই অনুমোদন পাওয়া গেল, তা নিয়ে এখন ক্রীড়াজগত্‍ সরগরম৷ সংবাদমাধ্যম গোটা প্রক্রিয়াটিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে খুঁটিয়ে দেখা শুরু করেছে৷ ২০১৪-১৫ সালে 'সানডে টাইমস'-এর তদন্তের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য৷ জানা গিয়েছে, কাতারের পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে মনোনীত ফিফার কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যদের ৫০ হাজার থেকে ২০ লক্ষ ডলার পর্যন্ত দেওয়া হয়েছিল৷ ক্রীড়াপ্রেমিকদের কাছে সব থেকে দুশ্চিন্তার বিষয় হল, ফিফার বিভিন্ন কমিটির সদস্যদের মাঝে মাঝেই বিপুল অর্থ দেওয়া হয় অকারণেই৷ 
যেন ছোটোখাটো কোনও উপহার, স্রেফ তাঁদের খুশি রাখতে! যেমন, ২০১১ সালের জুন মাসে ফিফার সভাপতি পদের নির্বাচনের ঠিক আগে ফিফার ক্যরিবিয়ান কনফেডারেশনের প্রত্যেক সদস্যকে ত্রিনিদাদে একটি বৈঠকে যোগ দেওয়ার জন্যেই নগদে ৪০ হাজার ডলার করে দেওয়া হয়৷ এই বৈঠকে মহম্মদ বিন হাম্মাম সভাপতি পদে নির্বাচিত হওয়ার জন্য তাঁদের সহায়তা চেয়েছিলেন৷ এই কনফেডারেশনের তিন প্রতিনিধি- বাহামার ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের ফ্রেড লান, বার্মুডার ডেভিড সাবির এবং কেম্যান আইল্যান্ডসের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অন্যান্য প্রতিনিধিদের অধিকাংশকেই চুপচাপ সেই অর্থ পকেটস্থ করতে দেখে এবং তা নিয়ে তাঁদের টুঁ শব্দটিও না করতে তাঁরা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন৷ লান তখন বাহামা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি৷ এই কাণ্ড দেখে তিনি সভাপতি অ্যাশটন সিলিকে একটি এসএমএস করে লেখেন, 'সিলি, অনেকেই নগদ টাকা নিচ্ছেন৷ ভারি দুঃখের কথা... যা ঘটছে তাতে আমি সত্যিই অবাক হচ্ছি৷' সিলির উত্তর আসে, 'আমি হতাশ, কিন্তু অবাক হচ্ছি না৷ এ কাহিনি যখন বেরোবে আমরা যেন আমাদের সততা বজায় রাখতে পারি৷ এই অর্থের উপর আমাদের অ্যাসোসিয়েশন নির্ভরশীল নয়৷ আপনি মাথা উঁচু করে বিদায় নিতে পারবেন৷' 


যে ভাবে দুনিয়ার সব দেশই লবিস্টদের নিয়োগ এবং উপঢৌকনের ব্যবস্থা করেছিল সেটাই সব থেকে দুঃখের বিষয়৷ ব্যতিক্রম অবশ্য ছিল একটি দেশ- ইংল্যান্ড৷ সে দেশের কর্মকর্তারা সব কিছু একেবারে আইনমাফিক করেছিলেন৷ ফল- দু'টি মাত্র ভোট এবং ভোটাভুটির প্রথম রাউন্ডেই বিদায়৷ অন্যান্য যত দেশ এই দৌড়ে ছিল প্রত্যেকে লবিস্ট আর দালাল নিযুক্ত করেছিল নিজেদের পক্ষে ভোট টানতে৷ শুধু তাই নয়, বিভিন্ন মহাদেশ থেকে কার্যনির্বাহী কমিটিতে প্রতিনিধিত্বকারী সদস্যদের প্রভাবিত করতে এই সব লবিস্ট এবং দালালদের ১০ লক্ষ ডলার বা তারও বেশি মাইনের বন্দোবস্ত ছিল৷ এ ছাড়াও কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যদের অনেকেরই দাবির শেষ ছিল না- লাক্সারি এসইউভি গাড়ি চাই, অমুক জায়গায় বেড়াতে যাব, পরিবারের তমুক সদস্যের হাসপাতালের বিল মেটাতে হবে৷ এ সবের জন্য তাঁরা বিশ্বকাপ আয়োজনের দাবিদার বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি দলের প্রধানদের কাছে ই-মেল পাঠিয়ে ২৫ হাজার থেকে ১০ লক্ষ মার্কিন ডলার পর্যন্ত দাবি করে বসেছিলেন৷ বহু ক্ষেত্রেই সে সব অনুরোধ মেনেও নেওয়া হয়৷ কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য না রাজারাজড়া বোঝাই মুশকিল- প্রাইভেট জেট প্লেনে সফর, দেশের সেরা হোটেলের সেরা স্যুইটে থাকার ব্যবস্থা, মিশেলিন স্টার রেস্তোরাঁর শেফদের তৈরি খানাদানা৷ যেন কল্পলোকের এক দুনিয়া৷ এই সব সুযোগ সুবিধা, উপঢৌকন যেন তাঁদের ন্যায্য প্রাপ্য৷ কাদের? যাঁদের উপর নির্ভর করে ফুটবল দুনিয়ার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ নানা সিদ্ধান্ত৷ কাজেই গোটা প্রক্রিয়াটাই একটা তামাশায় পরিণত হয়৷ এমন একটা সংস্থায় যার অন্যতম ঘোষিত আদর্শ হল- 'ফেয়ার প্লে'৷ একে অবিশ্বাস্য ছাড়া আর কী ভাবেই বা বর্ণনা করা যায়? 

কিমাশ্চর্যম! ক্ষমতার শীর্ষে যাঁরা বসে আছেন তাঁরা কিন্তু কখনও এ সব ক্রিয়াকলাপের নিন্দা করেননি৷ ফিফার সভাপতির মাইনে কত? সংবাদমাধ্যমের কেউ জানেন না৷ কার্যনির্বাহী কমিটির ২৪ সদস্য কত টাকা পেয়ে থাকেন তাও এক ভারি গোপন বিষয়৷ জুরিখে তাঁরা যখন বৈঠক করতে যান, দৈনিক ভাতা পেয়ে থাকেন ১০ হাজার ডলার পর্যন্ত৷ তার অধিকাংশটাই আবার নগদ৷ কাজেই কোনও দলিল নেই৷ অতএব ফিফাতে ইদানীং যে সব কাণ্ড ঘটছে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই৷ আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি আজকাল এ ধরণের অন্যায় থেকে নিজেকে আলাদা রাখতে সক্ষম হয়েছে বটে, কিন্তু তার ইতিহাসও যথেষ্ট গোলমেলে৷ কাজেই আমাদের মনে রাখতেই হবে যে ক্রীড়া জগতের শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানগুলিও ক্ষমতা আর অর্থলোভের শিকার হয়েছে৷ 

বিংশ শতকের শেষাশেষি ঘুষের অভিযোগ উঠেছিল আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির বিরুদ্ধে৷ সে সময় আইওসি একটি 'রিফর্মস কমিশন' নিয়োগ করেন৷ তারও প্রধান ছিলেন রিচার্ড পাউন্ড৷ তিনি বেশ কিছু দেশের সদস্যপদ খারিজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন৷ সে সময় এ-ও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, অলিম্পিক আয়োজনের দাবিদার কোনও শহরে কোনও প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে কমিটির কোনও সদস্য যেতে পারবেন না৷ কারণ দেখা গিয়েছে বিভিন্ন দুর্নীতির মূলেই ছিল এ ধরনের সফর৷ কিন্তু যদি কোনও সদস্য গোপনে এ ধরণের সফরে অংশ নেন, যেমনটা হয়েছে মাঝে-সাঝে? বাস্তব এটাই যে সে ক্ষেত্রে কমিটির প্রায় কিছুই করণীয় থাকে না৷ 

এ সব ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানই 'ফেয়ার প্লে' এবং 'স্পোর্টসসম্যান স্পিরিট'-এর আদর্শের কথা বলে৷ বলে সততা ও স্বচ্ছতার কথা৷ কিন্তু এই সব ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান কি কার্যক্ষেত্রে এগুলি পালন করে? বিশ্ব ফুটবলের উচ্চতম সংস্থা- যে সংস্থা শত শত কোটি টাকার মালিক, সেই ফিফা কি আদৌ কখনও চক্রান্ত আর কেলেঙ্কারি-মুক্ত হতে পারবে? শোনা যাচ্ছে, যদি সেপ ব্ল্যাটার আদৌ পদত্যাগ করেন তাহলে নাকি তাঁর পদ নেবেন ইসা হায়াটু৷ কিন্তু তা হলেও কি তিনি ফিফাকে দুর্নীতিমুক্ত করতে পারবেন? ২০০২ সালের ভোটাভুটিতে হায়াটু হেরে যান ব্ল্যাটারের কাছে৷ 'সানডে টাইমস' তদন্ত চালিয়ে যে দুর্নীতি ফাঁস করেছে হায়াটুও তার সঙ্গে জড়িত ছিলেন৷ 

বিখ্যাত ফুটবল কোচ বিল শ্যাঙ্কলির সেই অমোঘ উক্তি মনে পড়ে, 'অনেকেই বলে থাকেন ফুটবল জীবন-মৃত্যুর ব্যাপার, আমি বলি আসলে তা তার থেকেও অনেক গম্ভীর ব্যাপার৷' আমাদের মানতেই হবে যে খেলার মাঠে আমরা যা ঘটতে দেখি সেটাই পুরো গল্প নয়৷ মেসি কিংবা রোনাল্ডো কিংবা নেইমার আসল গল্প নন৷ আসল গল্পটা ঘটে বন্ধ দরজার পিছনে৷ আর সে গল্প অতি পঙ্কিল৷ আর সত্যি বলতে কি, এই দুর্নীতির কোনও শেষ চোখে পড়ছে না৷ 
আদৌ কি কখনও দুর্নীতিমুক্ত হতে পারবে ফিফা? আদৌ কি কখনও দুর্নীতিমুক্ত হতে পারবে ফিফা? Reviewed by Thailand Life on 1:05 AM Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.