এই জন্যই হয়ত বলে ম্যারেজেস আর মেড ইন হেভেন!
এক দিকে, দুর্ঘটনায় দুই হাত হারানো কটন কলেজের ছাত্রী. অন্য দিকে ১৯ বছর অজ্ঞাতবাসে থেকে ভারতের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো আলফার প্রতিষ্ঠাতা উপ সভাপতি। এক জন দীর্ঘ লড়াইয়ের পরে নকল হাতের সাহায্যে লেখিকা ও সরকারি চাকুরে। অন্য জন ১২ বছর কারাবাসের পরে ২০১০ সালে মুক্তি পেয়ে শান্তি আলোচনায় বসেছেন। দু’জনের বয়সের ফারাক প্রায় দুই দশকের। আপাত দৃষ্টিতে এমন পাত্র-পাত্রীর চার হাত এক হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় থাকে না বললেই চলে। কিন্তু, দীর্ঘ দিনের আলাপ, অভিভাবকত্ব আর নির্ভরতার রাস্তা বেয়েই  শেষ পর্যন্ত বৃহস্পতিবার বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন জুলি বরুয়া আর প্রদীপ গগৈ।

অসমের লখিমপুর জেলার ঢকুয়াখানার দুলিয়াগাঁয়ের বাসিন্দা ক্ষীরেন্দ্র বরুয়ার মেয়ে জুলি ২০০৬ সালের ১৩ মে লালুক এলাকায় এক দুর্ঘটনায় দু’টি হাতই হারায়। এর পর দাঁতে দাঁত চেপে কটন কলেজের মাস কমিউনিকেশনের ছাত্রীর স্বাভাবিক জীবনে ফেরার লড়াই চলতে থাকে। ছাত্র সংগঠন আসু জুলিকে দিল্লি নিয়ে যায়, যোগাড় করা হয় প্রায় সাড়ে ৬ লক্ষ টাকা। জার্মান সংস্থার তৈরি আধুনিক হাত লাগানো হয় জুলির দেহে। অটো বক সংস্থার তৈরি বৈদ্যুতিন ডান হাতটির কনুই ও কব্জিতে রয়েছে মোটর। তা দিয়ে নকল ডান হাত প্রায় সব ধরনের কাজ করতে সক্ষম। কিন্তু, গুঁড়িয়ে যাওয়া বাঁ হাতটির জায়গায় যে নকল হাত লাগানো রয়েছে তা দিয়ে কোনও কাজ করা যায় না।
গত বছর, জুলির জন্য অসমের নামকরা উদ্ভাবক উদ্ধব ভরালি বিশেষ ভাবে তৈরি করে দেন খাদ্যগ্রহণের স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র। পড়শোনা শেষ করার পাশাপাশি জুলি দু’টি বইও লেখেন—‘বিজয়িনী’ এবং ‘ক্রিস্টি ব্রাউন আরু মোই’। জুলিকে নিয়েও লেখা হয় বই। জুলি বর্তমানে রাজ্য তথ্য ও প্রচার দফতরে কর্মরত। তাঁর লড়াইয়ে গল্প অনেককে অনুপ্রাণিত করে।
অন্য দিকে ১৯৭৯ সালে অরবিন্দ রাজখোয়া, অনুপ চেতিয়া, পরেশ বরুয়াদের সঙ্গে মিলে শিবসাগর রংঘরের সামনে আলফার জন্ম দেন বেতাবাড়ি মাহুতগাঁওয়ের বাসিন্দা প্রদীপ গগৈ। আলফা তৈরির পর থেকে আর তিনি ঘরমুখো হননি। দীর্ঘ দিন ধরে বাংলাদেশ, মায়ানমার, ভুটান থেকে ভারত বিরোধী লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার পরে ১৯৯৮ সালে কলকাতায় তিনি ধরা পড়েন। সেই থেকে প্রদীপবাবু জেলে বন্দি ছিলেন। জামিন পান ২০১০ সালে। এরপর গগৈ এবং আলফা সভাপতি অরবিন্দ রাজখোয়ার নেতৃত্বে ভারত সরকার ও আলফার মধ্যে শান্তি আলোচনা শুরু হয়। আলফার কেন্দ্রীয় কমিটির সিংহভাগই শান্তি আলোচনায় যোগ দিলেও সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেতিয়া এখনও বাংলাদেশের জেলে আছেন। আলফা স্বাধীন গড়ে পরেশ বরুয়া জানিয়ে দিয়েছেন তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন।
জুলি জানান, প্রথম বার হাসপাতালেই প্রদীপবাবুকে দেখেন তিনি। প্রথম দর্শনেই প্রেম? প্রশ্নই ওঠে না। জুলি বলেন, তখন তো আলফা নেতা শুনেই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। আর বাড়িতেও বিভিন্ন বিয়ের প্রস্তাব আসছিল। কিন্তু, কাউকেই পছন্দ হচ্ছিল না। দুই হাত খোয়াবার পরে, নিজের পায়ে দাঁড়াবার চিন্তাটাই তখন মুখ্য ছিল। সহানুভূতির সম্পর্ক দরকার ছিল না। নববধূ জানান, প্রদীপবাবু তাঁর ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। পরিবারে সদস্যের মতোই হয়ে উঠেছিলেন প্রায়। কিন্তু, প্রেমিক নন, প্রদীপবাবু ছিলেন জুলিদেবীর অভিভাবকের মতোই। তাঁর উপরে অনেকটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন জুলি।
এই বছরের জন্মদিন জুলি পালন করেছিলেন গুয়াহাটির আমার ঘর-বৃদ্ধাশ্রমে। তখনও বিয়ের কথা ভাবেন নি। কিন্তু, বিহুর আশপাশে, প্রথম বার প্রদীববাবু নিজেই বিয়ের প্রস্তাব দেন। জুলির পরিবার বিয়েতে সম্মতিই দেয়। বিয়ে সেরে খুশি প্রদীববাবু বলেন, “জুলির সৃজনশীলতা ও সংগ্রামে উৎসাহ দেওয়াটাই আমার বড় কাজ। জুলি সাহাসিনী। সৃষ্টিশীল। তাই মনে হল, ওঁর লড়াইতে সারা জীবন সঙ্গ দেওয়া গেলে ভাল হয়।” লখিমপুরের ডুলিয়াগাঁওতে হওয়া দুই ‘লড়াকু’ বর-কনের বিয়েতে নিতবরের ভূমিকায় ছিলেন আলফার অর্থ সচিব চিত্রবন হাজরিকা।