শুধু কৃত্রিম আলো নয়, কাজে লাগান প্রকৃতিকে
কোনও বস্ত্তর উপরে যখনই প্রতিফলিত হয় আলো, ঠিক তখনই সেই বস্ত্ত আমাদের চোখে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে৷ কোনও বস্ত্তর দৃশ্যমানতা নির্ভর করে তার উপর আলোর প্রতিফলন ঘটছে কি না৷ অন্ধকারে তাই কোনও কিছুই স্পষ্ট দৃশ্যমান হয় না৷ আলোহীন ঘরকে দৃশ্যমান করে তোলার জন্য বোতাম বা সুইচ টিপে আলো জ্বালাতে হয়৷ আজকের বিষয় ঘরের আলো৷
নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, শহরের রাস্তা-ঘাট, পথের পাশের বাড়ির বাইরেটা বা কোনও বাড়ির অন্দরমহল- এই সব কিছু দিনের বেলায় লাগে এক রকম দেখতে, আবার রাতের আলোয় তার চেহারাটা সম্পূর্ণ অন্যরকম৷ যে পোড়ো বাড়ির আনাচ-কানাচে দিনের আলোয় আপনি নির্ভয়ে ঘুরতে পারেন, অন্ধকার নামলেই সেখানেই গা-ছমছমে অনুভূতি৷ অর্থাত্, আলোর তারতম্য একই বস্ত্তকে ভিন্নতর মাত্রা এনে দেয়৷ শুধু ভিন্নতর মাত্রা নয়, ভিন্নতর মুডও৷ থিয়েটার মঞ্চে একই সেট-এ শুধুমাত্র আলোর রঙ এবং আলোর বিন্যাসের বদলে যে কতো ফারাক ঘটে যায় মুডের তা আমরা সকলেই চাক্ষুষ করেছি৷
আমাদের আলোচনা যেহেতু ঘরের আলো নিয়ে, তাই সরাসরি এবার সে প্রসঙ্গে৷ অনেক বাড়িতেই দিনের আলো বা 'ন্যাচারাল লাইট' সব জায়গায় পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকবে না৷ না-থাকাই স্বাভাবিক, কারণ গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা বহুতল বাড়ির ছাত-দেওয়াল টপকে আপনার বাড়িতে যে একটা সময়ে অন্তত এক ফালি রোদ্দুর ঢুকতে পারছে সেটাই অনেক৷ আবার, আপনার বাড়ির ডিজাইনটাই এমন, যে কাছাকাছি বাড়ি না থাকলেও কোনও ঘরে সূর্যের আলো ঢুকতেই পারে না৷ যেমন, অনেক বাড়ির ড্রইংরুমের অবস্থিতি এমন জায়গায়, যে সেখানে চারপাশে ঘর থাকার ন্যাচারাল লাইট আসতেই পারে না৷ অথচ, বাড়ির অন্য ঘরগুলোয় প্রকৃতির আলোয় দিনের বেলায় কোনও কিছু দেখতে অসুবিধে হয় না৷ এমতাবস্তায়, আলোর কারিগর বা 'লাইট-ম্যানেজমেন্ট' যাঁরা করেন, তাঁরা একই সঙ্গে ন্যাচারাল লাইট এবং আর্টিফিশিয়াল লাইট পাঞ্চ করে ঘরকে দৃশ্যময় করে তোলার পরামর্শ দিয়ে থাকেন৷
ঘরের জানলা হলো ন্যাচারাল লাইট বা প্রাকৃতিক আলো আসার অন্যতম পথ৷ অতএব, বাড়ির যে-সব ঘরে প্রাকৃতিক আলো আসায় কোনও বাধা নেই, সেই সব ঘরে বড়ো জানালা থাকাটা আবশ্যক৷ সেই জানলায় পরদা বসিয়ে ঘরের আলোর পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব৷ কিন্ত্ত যে-ঘরে জানালা বসানোর জায়গা নেই, সেই ঘরে প্রাকৃতিক আলো নিয়ে আসার একমাত্র রাস্তা হলো স্কাই-লাইট৷ ঘরের ছাতে, বা দেওয়ালের উপরের দিকে এই স্কাই-লাইটের ব্যবস্থা করা যেতে পারে৷ কিন্ত্ত ফ্ল্যাট-বাড়িতে সেই সম্ভাবনা শূন্য, অতএব, স্কাই-লাইটের পরিকল্পনা বাতিল করা যেতে পারে৷ এমতাবস্থায় জানলাহীন ড্রইংরুমে অথবা ডাইনিং স্পেসে দিনের বেলাতেও আর্টিফিসিয়াল লাইট বিকল্প হিসেবে কাজ করবে৷
একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে আপনার ঘর যতো সুন্দর করে সাজানোই হোক না কেন, যদি ঘরের আলো ঠিক না থাকে তাহলে সব কিছুই মূল্যহীন৷ কারণ, দেখা যাবে না কিছুই৷ ফলে, বাড়ি তৈরির কাজে আর্কিটেক্টরা ঠিক যতোটা গুরুত্বপূর্ণ আপনার কাছে ঠিক ততোটাই গুরুত্বপূর্ণ আপনার বাড়ির 'লাইটিং কনসালট্যান্ট'৷ এ-কারণেই এই পেশার গুরুত্ব ইদানীং সময়ে বেশ বেশি৷ মূলত রাতের বেলায়, যে কোনও ঘরের ক্ষেত্রেই দু-ধরনের আলোর প্রয়োজন হয়৷ এক, 'জেনারেল ডিফিউজড লাইট', যা গোটা ঘরটা বা ঘরের স্পেসটাকে সমানভাবে আলোকিত করবে৷ এবং দুই, 'কনসেন্ট্রেটেড লাইট', যা কাজকর্ম বা ঘরের 'ডিসপ্লে' বস্ত্তগুলিকে ভালোভাবে দেখতে সাহায্য করবে৷
'জেনারেল ডিফিউজড লাইট' অনেকটা দিনের বেলার নরম ছায়াহীন আলোর এফেক্ট এনে দেবে ঘরে৷ পেশাদার কনসালট্যান্টর বলেন এই জেনারেল লাইটিংটা ডিমার-কন্ট্রোলড হলে ভালো হয়৷ প্রয়োজনে আলোর মাত্রা কমিয়ে-বাড়িয়ে ঘরের মুডের বদল ঘটানো সম্ভব৷ এই জেনারেল লাইট-এর পরিপূরকই হলো কনসেন্ট্রেটেড লাইট৷ এই আলো ঘন হয়ে পড়বে হয়তো ডেস্কে, কিংবা দেওয়ালের পেন্টিংয়ে, অথবা কিচেন-কাউন্টারে৷ এই কনসেন্ট্রেটেড লাইট কখনও হতে পারে 'টাস্ক লাইট', যা কোনও একটা ছোট্ট জায়গা আলোকিত করবে৷ এই টাস্ক লাইট জেনারেল লাইটের চেয়ে তিনগুণ উজ্জ্বল হতে হবে৷ মূলত বই পড়া বা লেখা-লিখির প্রয়োজনে এই টাস্ক-লাইট প্রয়োজন৷ অথবা, রান্না-বান্নার কাজের সময়ে৷ আবার কনসেন্ট্রেটেড লাইট হতে পারে 'অ্যাকসেন্ট লাইট'৷ ঘরের দ্রষ্টব্য বস্ত্ত, যেমন পেন্টিং, স্কাল্পচার, ফোটোগ্রাফ এই সব কিছুর উপর অ্যাকসেন্ট লাইট-এর আলো প্রয়োজন, যাতে চোখ টেনে নিয়ে যায় সেই দিকে৷ বিশেষজ্ঞদের মতে 'অ্যাকসেন্ট লাইট' হিসেবে হ্যালোজেন ল্যাম্প সবার সেরা৷ অ্যাকসেন্ট লাইট পড়ে 'বিম'-এর মতো, কখনও ছড়িয়ে পড়ে না৷
কেমন হতে পারে আপনার লাইটিং-স্কিম এবং কেন?
বাড়ির অন্দরমহলের লাইটিং-এর অন্যতম ভূমিকা হলো যে উদ্দেশ্যে আলো লাগানো সেই উদ্দেশ্য পালন করা৷ অর্থাত্, গোটা ঘরকে দৃশ্যমান করে তোলা৷ এই উদ্দেশ্যের বাইরে চলে গেলে বিদ্যুতের অপচয় ছাড়া আর কিছু হবে না৷
আলো ঘরের কোথায় বসাবেন এবং কেমন আলো বসাবেন এটা নির্ভর করবে ঘরের মাপ, ঘরের কোথায় কোন আসবাব রাখবেন, ঘরের দেওয়ালের রঙ কেমন, ঘরে প্রাকৃতিক আলো কতোটা আসে- এই সব কিছুর উপর৷ আপনার ঘরে লাগানো আলো প্রয়োজনে ঘরের রঙের ঔজ্জ্বল্য বাড়িয়ে তুলতে যেমন পারে, তেমনই প্রয়োজনে ঔজ্জ্বল্য কমিয়েও আনতে পারে৷ দেওয়ালে প্রতিফলিত হয়ে ঘরের 'স্পেস' সম্পর্কে একধরনের ইলিউশন বা ভ্রমও তৈরি করতে পারে আলো৷ ঘরে যদি 'ট্র্যাক' লাইট ব্যবহার করেন তাহলে সেই আলো দেওয়ালের রঙকে করে তুলবে, প্রয়োজনে নরম৷ প্রয়োজনে 'ট্র্যাক' লাইটের 'নেক' মুভমেন্ট বা 'পজিশন' বদল ঘটিয়ে ঠিক কোথায় আলো ফেলতে চাইছেন এবং কতোটা ফেলতে চাইছেন সেটাও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব৷
এবারে জেনে নেওয়া যাক কীভাবে তৈরি করবেন, আপনার বাড়ির বিভিন্ন অঞ্চলের লাইটিং স্কিম, এবং সেটা ঠিক করতে হলে আপনাকে এগোতে হবে কোন পথে? তবে একটাই কথা, এই লাইটিং স্কিম তৈরি করতে হবে ঘর সাজানোর অনেক আগে৷ এবং এই স্কিম তৈরির সময়ে ঘরের কোন আসবাব কোথায় থাকবে তারও একটা ছক তৈরি করে নিতে হবে আপনাকে৷ নইলে, আপনার 'লাইটিং কনসালট্যান্ট' কিছুই করে উঠতে পারবেন না৷ সঙ্গে অবশ্যই বাড়ির ফ্লোর-প্ল্যানটি রাখবেন৷
ড্রইং রুম: আড্ডা ঘর বা বসার ঘরে 'ডাউন' লাইটিং প্রয়োজন৷ এর ফলে গোটা ঘরে সমানভাবে নরম একটা আলো ছড়িয়ে থাকবে৷ এর সঙ্গে 'অ্যাকসেন্ট' লাইট বা 'স্পট' লাইট ব্যবহার করতে হবে ঘরের মধ্যে সাজানো বস্ত্তর উপর৷ এর বাইরে বসার ঘরে থাকবে সোফা, চেয়ার ইত্যাদি৷ সোফায় বসে কিংবা ইজি-চেয়ারে বসে বই বা কাগজ পড়ার জন্য পাশে 'স্ট্যান্ড' লাইট ব্যবহার করা যেতে পারে৷ কিন্ত্ত এই ধরনের আলো বেশি ব্যবহার করলে ঘরটাকে ল্যাম্প শেডের দোকান মনে হতে পারে, কারণ, স্ট্যান্ড লাইট শেড ছাড়া ব্যবহার করা সম্ভব নয়৷ তাই সংখ্যায় একটির বেশি এমন আলো ব্যবহার না করাই ভালো৷
বেড রুম: এই ঘরে দু-ধরনের আলো প্রয়োজন৷ এক, পেরিফেরি লাইটিং অর্থাত্, গোটা ঘরটাকে স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে৷ এই লাইটিং যদি ডিমার কন্ট্রোলড হয়, তাহলে সুবিধে৷ প্রয়োজনে ঔজ্জ্বল্য কমানো-বাড়ানো যেতে পারে৷ আর দ্বিতীয় ধরনের আলো হলো 'স্পট' লাইট৷ এই স্পট লাইট একটা নির্দিষ্ট এলাকাতেই আলো ফেলবে৷ হতে পারে ঘুমোনোর আগে গল্পের বই আপনার পড়া চাই-ই৷ যে-
ক্ষেত্রে এই স্পট লাইটটি কাজে আসবে৷
কিচেন এরিয়া: রান্না করার জায়গায় লাইটিং প্ল্যান করার সময় কী-কোথায়-কখন করছেন সেই অ্যাক্টিভিটি-এরিয়াটা চিহ্নিত করে কোথায় কতোটা আলোর ঔজ্জ্বল্য লাগবে সেটা ভেবে নিয়ে এগোতে হবে৷ এমনকী টিভি দেখার জায়গাতেও আলোর ইনটেনসিটি কতোটা রাখবেন সেটা ভেবে নিতে হবে অনেক আগে থেকেই৷ লাইটিং এক্সপার্টকে আপনার এই প্রয়োজনের ব্যাপারটা জানিয়ে দিলেই তাঁরা আপনাকে সম্ভাব্য স্কিমের হদিশ দিয়ে দিতে পারবেন৷
ডাইনিং স্পেস: যে কোনও বাড়ির অন্দরমহলের লাইটিং স্কিম ডিজাইন করার সময় বাড়ির একটি ফোকাল পয়েন্ট নির্ধারণ করে নিতে হবে৷ সেখানেই থাকবে ফোকাস অফ দ্য স্কিম৷ বাড়ির হল ঘর যদি খুব বড়ো হয়, তাহলে ঠিক মধ্যিখানে একটি স্যান্ডেলিয়ার ঝুলিয়ে দিলেই সেটি দিব্যি ফোকাল পয়েন্ট হয়ে উঠবে৷ কিন্ত্ত ফ্ল্যাট বাড়ির খুপরিতে শ্যান্ডেলিয়ার-ভাবনাটা বেশ বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে৷ তাই আপনার লাইটিং স্কিমের ফোকাল পয়েন্ট হোক ডাইনিং টেবিলের উপরে সিলিং থেকে ঝুলতে থাকা একটি পেনড্যান্ট লাইট৷ আলোর ঔজ্জ্বল্য যেন খুব কম না হয়, আবার খুব বেশিও না হয়৷ তাই এ-ক্ষেত্রেও ডিমার ব্যবহার করা যেতে পারে প্রয়োজনে৷
সিঁড়ি: যে-কোনও বাড়িরই আলোর ক্ষেত্রে এই এলাকাটি সব চেয়ে অবহেলিত৷ যেহেতু সিঁড়ির অ্যাঙ্গল বা ওঠা-নামার কোন কোনও বিশেষ নিয়ম মেনে তৈরি হয় না, তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সিলিং-এর স্পট লাইট গোটা সিঁড়িটাকে আলোকিত করতে পারে না৷ ফলে পাশাপাশি সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ ফ্লোর-লাইট লাগালে এই সমস্যার সুরাহা হতে পারে৷
শুধু কৃত্রিম আলো নয়, কাজে লাগান প্রকৃতিকে
Reviewed by Thailand Life
on
7:47 AM
Rating:
No comments: