তেজি বুড়ো

বিনয়বাবু দোতালার জানালা দিয়ে উঁকি মেরে ফুটপাথে বিহারির চায়ের দোকান এই প্রবল বর্ষণস্নাত কাকভোরেও খুলেছে দেখে উত্তেজনাবশত রাষ্ট্রভাষায় চেঁচিয়েই ফেললেন- 'এই শালা, হাম কেটলি নামায়গা, জলদি চার কাপ চায় ডাল দো নইলে তুমারাই একদিন কী হামারাই একদিন৷' কেটলি নামানোর অর্থ হাতলে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া৷ বিস্কুট টেবিলের ওপর প্লাস্টিকের কৌটোয় রাখাই থাকে৷ রিটায়ার করেছেন সিক্স ইয়ার্স৷ কমলা ছেলের সঙ্গে লিভারপুলে আজ বহুকাল৷ 'থাকো গিয়ে বিলেতে, তবে আসার আগে অ্যাট লিস্ট তিন মাসের অগ্রিম নোটিস যদি মনে করো দিতে পারবে না, তা হলে সদর দরজার ডুপ্লিকেট চাবি বানিয়ে নিয়ে যাও৷ বাকি জীবনটা পাহাড়ে পর্বতেই কাটাবো, চরৈবেতি, চরৈবেতি৷' 

গত ছ'বছর বিনয়বাবু চরৈবেতি বলতে এক বার পার্কসার্কাস গেছিলেন স্ট্যান্ডার্ড মিট শপ থেকে রেওয়াজি মাংস কিনতে৷ দোকানদারকে ব্যাধ গীতা সম্বন্ধে ঘণ্টা দুয়েক জ্ঞান দেবার পর কী হয়েছিল ঠিক জানা যায় না, তবে ওঁরা চাহিদা অনুযায়ী মাংস বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যায় তার পর থেকে৷ নো ডেলিভারি চার্জ৷ বাজার করে রামুর মা- ঘর মোছে, বাসন মাজে, হেরিকেন মোছা শেষ করে তেল ভরে সলতে উসকে মশার ধূপ জ্বালিয়ে লুচি ভেজে আলুরদম রেকাবিতে বেড়ে তেতলার ছাদে উঠে হাঁকও পাড়ে- 'ও সেজ দাদাবাবু, ও মেজদাদা, ও টেকো পোনোবদা, তোমাদের বিজ খেলার সময় হয়েছে, নুচি হয়েচে, শিগগির এসো৷' বিনয়বাবু আকাশে মেঘের পরিমাণ, ঘনত্ব, কিউমিউলাস না নিম্বাস ইত্যাদি নিয়ে মনে মনে ঝট করে একখানা হিসেব সেরে রোজকার মতো কিশোরী আমনকারের মিঁঞা কী মলহারটাই ফের এক বার চালিয়ে দেন- 'বুঝলে শ্যামল, বাঙালির গানবাজনা হল না কারণ, বউ রান্নাঘরে তালের বড়া ভাজছে, একগাদা ছেলেপুলে চিত্‍কার করে নেসফিল্ড পড়ছে আর এঁরা পা ছড়িয়ে রাম খাচ্ছে৷ রিডিক্যুলাস! এই দ্যাখো, আমি কেমন ফ্রি৷ সকালবিকেল ফৈয়াজ, আব্দুল করিম, ভীমসেন আর ওই ছোকরা কী যেন নাম আলি আকবর না কী যেন, টিং টিং করে বাজায়, তাঁদের নিয়েই কাটিয়ে দিচ্ছি৷ সন্ধ্যের পর একটু গ্লেন, একটু ব্রিজ, দু'কলি রেবা মুহুরি, রাতে কেসরবাই৷' 


বিনয়বাবুর ঘরের একপাশে আলনায় কয়েকটি ধুতি, পাঞ্জাবি, হাওয়াই শার্ট৷ হেঁসেলে ওই লুচি ভাজার জন্য মিনিমাম যেটুকু বাসনকোসন বেলুন চাকি৷ বাকি সব এক দিন 'এই ইধার আও' বলে এক পুরনা খবরের কাগজওলাকে বিক্রি করে দিয়েছেন৷ রামুর মা কাঁইমাই করায় বলেছিলেন, 'মাইজি আনেসে আবার কেনা হোগা, ডরো মাত্৷' ফর্সা বিছানায় সাদা চাদর পেতে ঘুমোন, ঘরেই চটি পায়ে ফটাং ফটাং করে ঘোরেন, একটাই জামা গায়ে সাত দিন কাটিয়ে দেন কাউকে রেয়াত না করে৷ মেডিক্লেইমের টাকা দেওয়া বন্ধ করেছেন বহুকাল, লুচি ভাজার কড়াইতেই শুয়োরের মাংস রান্না করেন প্রতি শনিবার এবং গত কয়েক মাস যাবত্ সুগারের ওষুধ না কিনে সে টাকায় ডব্লিউ হিথ রবিনসনের বইগুলো একটা একটা করে খরিদ করা শুরু করেছেন৷ 'বেশ করব শালা৷ কিছুতেই একশো বছর বাঁচব না আই সিম্পলি রিফিউজ! কার বাবার কী!!' 

কেটলি থেকে কাপে চা ঢেলে বিনয়বাবু সামনের দেওয়ালে টাঙানো তাঁর এবং কমলার বিয়ের ছবিটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন কী যেন ভেবে৷ পাশে ছেলের ছবি, ক্রিকেট ব্যাট হাতে কায়দা মেরে দাঁড়িয়ে আছে ক্লাবের বারান্দায়৷ বিনয়বাবু মিটিমিটি হাসতেই হাসতেই চায়ের কাপে চুমুক দেন, আর হেসেই চলেন কেবল...
তেজি বুড়ো তেজি বুড়ো Reviewed by Thailand Life on 10:45 PM Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.