রং দিয়ে ছবি এঁকে বদলে দিন ঘরের মেঝে

কথায় আছে পুরনো মদ নতুন বোতলে৷ ঘর সাজানোর ব্যাপারটাও অনেকটা তাই৷ নইলে বাঙালি আদ্যিকালের আর্ট আলপনা আবার ফিরে আসে নয়া চেহারায়!
ঘরের সিলিং থেকে সামান্য নীচে দেওয়ালের গায়ে ব্র্যানেট আটকে, তার উপর কাঠের প্ল্যাটফর্ম বানিয়ে শিল্পী মিকেলাঞ্জেলো সিলিং-এ ছবি এঁকেছিলেন৷ ছোটোখাটো সিলিং নয়, ১৩০ ফুট লম্বা আর ৪৮ ফুট চওড়া৷ অবিশ্যি একদিনে এঁকে উঠতে পারেননি৷ প্রায় চার বছর সময় লেগেছিল তাঁর এই ছবি আঁকতে৷ ন'টা টুকরোয় বাইবেল-এর 'বুক অফ জেনেসিস' ন'টি দৃশ্যে এঁকেছিলেন ১৫০৮ সাল থেকে ১৫১২ সাল পর্যন্ত৷ দীর্ঘ চারশো বছর পরেও নিত্যদিন হাজার-হাজার মানুষ এই ছবি দেখতে ছুটে আসেন বিখ্যাত সিসটিন চ্যাপেলে৷

না, চার বছর ধরে আপনার বাড়ির সিলিং-এ ছবি আঁকতে বলছি না৷ ওই হ্যাপা পোয়ানো চাট্টিখানি কথা নয়৷ আর তা-ছাড়া বাড়ির সিলিং এতোদিন ধরে ছবি আঁকার জন্য আটকে রেখে দিলে থাকবেন কোথায়? অতএব, সিলিং নয়, ছবি আঁকুন ঘরের মেঝেতে৷ জেনে রাখুন, ফ্লোর পেন্টিং হলো এই মুহূর্তে ঘর-সাজানোয় 'ইন-থিং'৷ আজকের বিষয় 'ফ্লোর পেন্টিং'৷
আপনি অবিশ্যি ফ্লোর পেন্টিং শুনে মুখ বেঁকিয়ে বলতেই পারেন, সে তো আদ্যিকালেও ছিলো৷ পুজো-পার্ব্বনে, উত্‍সবে, ঘরের মেঝেতে পিটুলি গোলা দিয়ে, আঙুলের ডগাকে ব্রাশ বানিয়ে যে-আলপনা দেওয়ার রীতি ছিলো, সে-তো ফ্লোর পেন্টিং-ই৷ গ্রামের দিকে বাড়িতে নতুন বউ এলে উঠোনে 'বউছত্র' এঁকে তাকে স্বাগত জানানোর রীতি ছিলো৷ বউছত্র হলো এক কিসিমের উঠোন-আলপনা৷ রবীন্দ্রনাথের 'গৃহপ্রবেশ' থেকে ছোট্ট একটা উদ্ধৃতি দিই৷ 'যতীন... মণি কোথায়? তাকে একবার- মাসী: তাকে সেই তেতলার নতুন ঘরটায় ফুল দিয়ে সাজিয়ে বসিয়ে দিয়েছি৷ যতীন: এ তোমার মাথায় কী করে এল? ভারি চমত্‍কার৷ দরজার দু-ধারে মঙ্গল ঘট দিয়েছ? মাসী: হ্যাঁ, দিয়েছি বৈকি৷ যতীন: আর মেঝেতে পদ্মফুলের আলপনা?'


অর্থাত্‍, ঘরের মেঝেতে আলপনা এঁকে ঘরের 'লুক' একেবারে আমূল বদলে দেওয়ার ব্যাপারটা চিরকালই ছিল৷ এই আলপনা আবার দু-রকমের৷ অন্তত, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই বলছেন, একটি ধরণ হলো, 'মানচিত্র' এবং অন্যটি মণ্ডন-শিল্প৷ প্রথমটি শিল্পকর্ম নয়, কিন্ত্ত দ্বিতীয়টি তাঁর মতে শিল্প৷ তাঁর লেখা 'বাংলার ব্রত' থেকে উদ্ধৃতিটি পড়লেই এই ফারাকটা বোঝা যাবে৷ 'বিভিন্ন ব্রত উপলক্ষে ঘরের মেঝেতে আলপনায় সাজানোর রীতি ছিলো বাংলাদেশে৷ আলপনাগুলি দেখি দুই শ্রেণির৷ একরকম আলপনা- সেগুলি কেবল অক্ষর বা চিত্রমূর্তি- কতোটা ইজিপ্টের চিত্রাক্ষরের মতো৷ এই সব আলপনায় মানুষ নানা অলংকারের বাসনা করে পিটুলির গোলা দিয়ে সেই সব গহনা, এঁকেছে৷ সেঁজুতি ব্রতের আলপনায় ঘর-বাড়ি, চন্দ্র-সূর্য, সুপুরি গাছ, রান্নাঘর, গোয়ালঘর সবই মানুষ এঁকেছে৷

কিন্ত্ত এদের তো শিল্পকর্ম বলে ধরা যায় না- এগুলি মন যা চায় তারই মোটামুটি মানচিত্র৷ কিন্ত্ত, এই যে নানা রকমের পদ্ম মানুষ কল্পনা করেছে, কিংবা এই যে কলালতা, খুন্তিলতা, শঙ্খলতা, চালতালতা প্রভৃতি লতা মণ্ডন, এই যে নানা রকম আসনের পিঁড়িচিত্র- এগুলি মণ্ডন-শিল্প, মানচিত্র নয়৷'

এর থেকে অনেক উন্নত মেঝে-অঙ্গন বা ফ্লোর-পেন্টিং আমরা দেখি 'গুপি গাইন বাঘা বাইন' সিনেমায় শুন্ডিরাজার সভাগৃহের মেঝেতে৷ শ্বেত পাথরের মেঝে জুড়ে কালো রঙের ফুল-লতাপাতার মাঝে প্রজাপতি আঁকা ছিলো৷ এই প্রজাপতির উপর দাঁড়িয়েই গুপি-বাঘা গেয়েছিল, 'মহারাজা, তোমারে সেলাম'৷ এটা কিন্ত্ত সেই অর্থে আলপনা নয়৷ বরং বলা ভালো 'ক্রিয়েটিভ আর্ট অন ফ্লোর৷' যে-কোনও ডিজাইনকে গ্রাফ পেপারের মতো কাগজে এঁকে নিয়ে, প্রতিটি খোপকে এক-একটি আলাদা মার্বল-টাইল হিসেবে ভেবে নিতে হবে৷ এক-একটি টাইলে এক-একটি খোপের মতো কিছুটা থাকবে সাদা আর বাকিটা কালো, অর্থাত্‍ ডিজাইনের অংশ এভাবেই তৈরি হবে টাইসল৷ এবার এই টাইলসগুলোকে মেঝেতে সাজিয়ে নিলেই ফুটে উঠবে কাঙ্খিত ডিজাইন৷ আধুনিক সময়ে ফ্লোর-পেন্টিংয়ের ক্ষেত্রে টাইলসকে এইভাবে তৈরি করে নেওয়া হয়৷ আপনি মেঝেতে কোন ধরনের ডিজাইন চান, সেটা ক্যাটালগ দেখে টাইলস কোম্পানিকে জানিয়ে দিলেই, তাঁরা আপনার বাড়িতে পৌঁছে দেবেন এমন চিত্রিত টালি৷

যখন এই সব চিত্রিত টালির ব্যবহার ছিল না,
তখন খালি মেঝেতে বৈচিত্র্য আনার জন্য ব্যবহার হতো নানা মাপের, নানা ডিজাইনের কার্পেট৷ আমাদের দেশ গ্রীষ্ম-প্রধান হলেও সাহেবদের দেখা-দেখি রঙ্গস বাঙালি-বাবুরাও ঘরের মেঝেতে কার্পেট পাতা শুরু করলেন৷ কার্পেট ব্যবহারের সুবিধে হলো কার্পেট বদলালেই ঘরের মেঝেও যাবে বদলে৷ টাইলস-ডিজাইন কিন্ত্ত ফিক্সড, একবার হয়ে গেলে তা বদলানোর হ্যাপা অনেক৷ কিন্ত্ত কার্পেটের সমস্যা হলো, এর নীচে ধুলো জমে থাকে, যে-ধুলো চোখে দেখা যায় না৷ এই কারণেই শরত্‍চন্দ্রের 'নব-বিধান'-এর নায়িকা তার শোওয়ার ঘরে কার্পেট পাততে চাইতো না৷


কিন্ত্ত আধুনিক শহুরে মানুষেরা নিজের ঘরের মেঝেয় পেন্টিং করতে চাইলে করবেনটা কী? পিটুলি গোলা দিয়ে আলপনা আঁকলে সেটা থাকবে না, পাতা যাবে না কার্পেটও৷ কিন্ত্ত সেই মুশকিলের আসান করবার জন্যে এগিয়ে এসেছেন রঙ কোম্পানিরা৷ তাঁর ম্যাড়মেড়ে সিমেন্ট কিংবা কাঠের মেঝেকে বদলে দেওয়ার জন্যে নানা কিসিমের অয়েল-বেসড রঙ বাজারে এনেছেন, যা আপনি নিজেই লাগিয়ে নিতে পারবেন আপনার মেঝেতে৷ এমনকী, রঙ লাগাতে গিয়ে যাতে ধেড়িয়ে না ফেলেন, তার জন্য 'গাইড-বুক' পর্যন্ত প্রকাশ করে ফেলেছেন৷
রং দিয়ে ছবি এঁকে বদলে দিন ঘরের মেঝে রং দিয়ে ছবি এঁকে বদলে দিন ঘরের মেঝে Reviewed by Thailand Life on 8:02 AM Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.