কেমন চেহারা হবে ভবিষ্যতের অফিসের
আপনার অফিসটা দেখতে কেমন? সেই অফিসে কাজ করার পদ্ধতিটাই বা কেমন? বরং প্রথমে আমি একটা অফিস-ঘরে কাজ করার 'ইশটাইল'-টা কেমন৷ কল্পনা করে নিন অফিসের বড়বাবু-মেজবাবু-ছোটবাবু কারওরই বসার আলাদা কোনও ঘর নেই৷ সবাই বসছেন একটাই ঘরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে৷ এমনকী যার যেখানে পছন্দ, সেখানে৷ এমনও হতে পারে সংস্থার সিইও আর গতকাল যে চাকরিতে ঢুকেছে সেই ছেলেটি বসছে পাশাপাশি বসার থেকে এ-টেবিল ও-টেবিল৷ ঘুরে-ঘুরেই কাজ চলছে বেশি৷ একের সঙ্গে অন্যে পরামর্শ করে, তবে সেই পরামর্শ একেবারেই গল্প করার ভঙ্গিতে৷ এক হাতে কফির কাপ অন্য হাতে ল্যাপটপ নিয়ে৷ যদিও এই অফিসে একটি মিটিং-ঘর আছে ঠিকই, কিন্ত্ত হঠাত্ জরুরি মিটিংয়ের দরকারে যদি দেখা যায় মিটিং-ঘরে অন্য কেউ বসে মিটিং করছে, তখন দলবল মিলে পাশের কফিশপে বসে সেই জরুরি মিটিং সেরে ফেলা হচ্ছে৷ কারও হয়তো বাড়িতে কাচের জারে গোল্ডফিশ আছে, কারও আছে ছোট্ট কুকুর ছানা- তারাও মালিকের সঙ্গে চলে এসেছে অফিসেই৷ হাজার চারেক স্ক্যোয়ার-ফুটের 'চিল আউট জোন'-এ গিয়ে কেউ সিগারেট খাচ্ছে, কেউ চুপচাপ বই পড়ছে, কেউ ছোট্ট করে ফুটবল খেলে নিচ্ছে অথবা শরীরটা জুত্সই লাগছে না বলে মাসাজ নিয়ে নিচ্ছে৷ একপাশে ডজন-খানেক ছেলে-মেয়েদের নাটকের রিহার্সেল করাচ্ছেন কোনও পেশাদার অভিনেতা, কারণ অফিসের রিক্রিয়েশন ক্লাবের নাটক হবে সামনের মাসে৷ যেহেতু এই অফিসে অনেক মেয়েই কাজ করে, তাই তাদের জন্যে পিং-পং খেলার বন্দোবস্ত আছে, যোগা-সেন্টার আছে, আর আছে অফুরন্ত খাবার-দাবার এবং একটি মাইক্রো-কিচেন যেখানে ফিশফ্রাই ভাজতে ভাজতে দু'জন খুব সিরিয়াসলি নতুন প্রজেক্টটা ঠিক কীভাবে কব্জা করলে সময় মতো উদ্ধার করা যাবে তা নিয়ে গল্প করছে৷ হঠাত্ই চোখে পড়বে হয়তো মায়ের টেবিলের পাশে একটি বাচ্চা ছেলে হোম-ওয়ার্ক করছে, আর মা কম্পিউটারে চোখ রেখে কাজ করে যাচ্ছে৷ সব মিলিয়ে কাজ ছাড়াও প্রত্যেকেই নিজের ইচ্ছে মতো নানা কিছু করলেও, কাজ করতে-করতেই এ-সব করছে৷ শুধু করছে বললে ভুল বলা হবে, প্রচন্ড এনার্জি নিয়ে হাসি মুখে করছে৷
কী বললেন, আপনার অফিসের চেহারা বা কাজের ধরন এ-রকম নয়? তাহলে বলতে বাধ্য হচ্ছি আপনার অফিসটি হলো আদ্যিকালের বদ্যিবুড়োর মতো৷ আর যে অফিসের কথা এতক্ষণ আপনাকে শোনালাম সেটা হলো 'অফিস অফ দ্য ফিউচার'৷ শুধু বিদেশে নয়, এ-দেশেও এমন অফিস এখন ভুরি-ভুরি৷ প্রায় প্রতিটি করপোরেট সংস্থাই তাদের অফিস এবং অফিসের কর্ম-সংস্কৃতিকে এই পথেই নিয়ে যাচ্ছে৷
যেহেতু অন্য কিসিমের অফিস, তাই এই অফিসের 'ওয়ার্ক-এথিক' বা কর্ম-নীতিও স্বতন্ত্র৷ 'নীতি' শব্দটি বড্ড ভারি, তাই বলা ভালো কাজের প্রতি মনোভাব৷ কর্মীদের মনোভাব৷ কিন্ত্ত হঠাত্ করে কী এমন ঘটল যে বদলে গেল অফিসের চেহারা আমূল আর ওয়ার্ক-এথিক? একটা ব্যাপার লক্ষ্য করা গিয়েছে যে দেশের অর্ধেক মানুষের গড় বয়স ২৫৷ 'টাইমলিজ' নামের এইচআর সার্ভিসেস কোম্পানির সমীক্ষা মতে, আগামী ২০ বছর ধরে প্রতি বছর ১ কোটি ২০ লক্ষ এই বয়সী তরুণ যোগ দেবেন কাজে৷ এর ফলে ২০১৫ সালের মধ্যে মোট কর্মীদের শতকরা ৭৫ জনই হবেন এই জেন-ওয়াই গোত্রের মানুষ৷ এবং এই 'জেন-ওয়াই' (যাঁদের জন্ম ১৯৮০ সালের পর এবং 'মিলেনিয়াল' যাদের জন্ম ১৯৯৫ সাল নাগাদ) কর্মীদের কাজের এবং কর্মস্থানের প্রতি অ্যাটিটিউড আগের প্রজন্মের মানুষের সম্পূর্ণ বিপরীত৷ ফলে, প্রতিটি সংস্থাই এই নয়া-প্রজন্মের কর্মীদের প্রতিনিয়ত নিজেকে আবিষ্কার করার প্রবণতাকে এবং কাজের প্রতি তাদের অ্যাটিটিউডকে মাথায় রেখেই ঢেলে সাজাচ্ছেন তাদের কর্ম-সংস্কৃতি এবং ওয়ার্ক-এথিক৷
যেহেতু এই প্রজন্ম প্রতিনিয়ত 'হটকে' চিন্তা-ভাবনা করতে অভ্যস্থ, তাই তাদের কাজের জায়গাটিকেও যে 'আউট অফ দ্য বক্স' হতে হবে এ-কথা স্বীকার করছেন প্রায় প্রতিটি বড়ো সংস্থার পিপল অপারেশনস-এর দায়িত্বে থাকা মানুষেরা৷
'ওপন ওয়ার্ক প্লেস বা উন্মুক্ত কাজের জায়গা থাকলে কর্মীদের ভাবনার আদান-প্রদানের স্রোত বইতে পারে ভালো৷ এ-ছাড়া ইন্টারন্যাল নেটওয়ার্ক-এর বন্দোবস্ত থাকায় এক জনের সঙ্গে অন্যজনের যোগাযোগ হয় দ্রুত, কাজটাও হয় তাড়াতাড়ি৷ 'কগনিজ্যান্ট' সংস্থার স্ট্র্যাটেজি বিভাগের এক্সিকিউটিভ ভাইস-প্রেসিডেন্ট ম্যালকম ফ্র্যাঙ্ক স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন 'মিলেনিয়াল প্রজন্ম বড়ো হয়েছে অন-লাইন করতে-করতে৷ প্রাচীন পন্থীদের সমস্যা সমাধানের কাজের ধারাটা ছিল ব্যক্তিগত অ্যাপ্রোচের মাধ্যমে, আর এই নবতম প্রজন্মের কাজের পদ্ধতিটা হলো ভার্চুয়াল টিম-সদস্যদের নিয়ে অন লাইনে৷' এর ফলে সংস্থার প্রোডাক্টিভিটি বেড়েছে শতকরা ১৫ ভাগ, আর অগ্রগতি হয়েছে শতকরা ৮ ভাগ৷ এইচসিএল-এর এইচআর প্রধান পৃথ্বী শেরগিল একধাপ এগিয়ে নতুন প্রজন্মের কর্মীদের সোস্যাল নেটওয়ার্কিং-এর মাধ্যমে কাজ করার নেশা ধরিয়ে দিয়েছেন৷ যেখানে ফেসবুক আর টুইটারকে এই প্রজন্মের কর্মীদের পক্ষে কাজের জায়গায় প্রধান অন্তরায় বলে ধরা হচ্ছিল এতোদিন৷ সেই জায়গাতেও পরিবর্তন আসছে৷ 'জেনপ্যাক্ট' সংস্থা কেবল কর্মীদের জানিয়ে রেখেছেন, 'এই সব সোস্যাল নেটওয়ার্কে নিজের কাজের কথা বলো, কিন্ত্ত সংস্থার কথা বলো না৷'
'ওয়ার্ক এথিক' নিয়ে নবীন-প্রবীণের মতভেদ
নতুন এবং পুরনোর মধ্যে সংঘাত থাকবেই৷ কারণ, দুই প্রজন্মের মধ্যে মূল্যবোধ এবং বেড়ে ওঠার পদ্ধতির মধ্যে ফারাক প্রচুর৷ কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ সে-প্রসঙ্গ বরং থাক৷ থাক কারণ, শেষ পর্যন্ত ভুবনের ভার নতুন প্রজন্মের হাতেই৷
'ওয়ার্ক এথিক' নিয়ে কিন্ত্ত মতভেদ আজকের নয়৷ তার আগে এই 'ওয়ার্ক এথিক' ব্যাপারটা কী সেটা একটু বুঝে নেওয়া যাক৷ ওয়ার্ক এথিক হলো কঠোর পরিশ্রম এবং অধ্যাবসায় দ্বারা জাত এক ধরণের মূল্যবোধ৷ ক্যাপিটালিস্টরা কর্মীদের এই কঠোর পরিশ্রমের ওপর বিশ্বাস রাখেন৷ 'টাইম ইজ মানি' অথবা 'টাকায় টাকা আসে' এই দুই আপ্তবাক্যই হলো তাদের মূল্যবোধ৷ আর এর সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে মার্কসিস্টদের ওয়ার্ক এথিক৷ শোষক এবং শোষিতের শ্রেণি বৈষম্যের প্রেক্ষিত থেকে তৈরি হওয়া এই এথিক৷
বরং স্টিভেন মালিগু চমত্কার ব্যাখ্যা দিয়েছেন ওয়ার্ক এথিক বিষয়ে৷ তাঁর মতে, কোনও কাজ সম্পর্কে এক জনের অ্যাটিটিউড, অনুভূতি এবং বিশ্বাসই জন্ম দেয় তার নিজস্ব ওয়ার্ক এথিকের৷ তিনি বলেছেন, ওয়ার্ক এথিক ব্যাপারটা বড়ো জটিল এবং ব্যক্তি-নির্ভর৷ একই সংস্থায় কর্মরত দুই কর্মীর ওয়ার্ক এথিক তাই এক হবে ধরে নেওয়া মুশকিল৷ অতএব, নব্য প্রজম্মের কথা মাথায় রেখে যে ধরনের অফিস তৈরি হচ্ছে, যে ধরনের ওয়ার্ক-এথিককে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে সেটা কতদূর যথাযথ তা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই৷
ফিরে আসা যাক নবীন-প্রবীণের সংঘাত প্রসঙ্গে৷ 'মাইন্ড ট্রি' সংস্থার চিফ পিপল অফিসার রবি শঙ্কর বলছেন, 'এই প্রজন্মের কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করা খুব কষ্টকর কাজ৷ আগের প্রজন্মের কর্মীরা স্থিতাবস্থায় বিশ্বাস রাখতেন, কিন্ত্ত আজকের প্রজন্ম সব বিষয়ে মতামত দিতে চায়৷ তারা বিশ্বাস করে সংস্থার আরও খোলাখুলি সব কিছু শেয়ার করা উচিত তাদের সঙ্গে৷ ফলে, কে ছোট কে বড়ো সে-সব মাথায় না রেখে যে কেউ যখন তখন যার-তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া উচিত৷' গুগল সংস্থার উদিতা তলওয়ার-এর মতে, 'নতুন প্রজন্মের কর্মীদের আমরা জানিয়েই রাখি যে কাজের ক্ষেত্রে উঁচু-নিচুর কালচারাল হায়ারআর্কি আমরা মানি না৷'
বেন্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন 'নবীন বনাম প্রবীণ' নিয়ে একটি গবেষণাই করে ফেলেছেন প্রায়৷ তাঁরা বলছেন, প্রবীণরা মনে করেন মিলেনিয়াল তেমন কঠোর পরিশ্রম করতে চায় না৷ আবার দশ জনের মধ্যে নয় জন মিলেনিয়াল বলেছেন, প্রবীণরা ভুল বলছেন, আমাদের খুব জোরদার ওয়ার্ক এথিক আছে৷ বরং অতীতের মানুষদের চেয়ে বেশিই আছে৷ অর্থাত্, খুব স্পষ্ট নবীন এবং প্রবীণদের মধ্যে একটা বিরাট রিয়েলিটি গ্যাপ রয়েছে৷
এ-রকম একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতেই এক নতুন ধরণের পেশাদার আত্মপ্রকাশ করেছেন৷ তাঁদের বলা হচ্ছে 'মিলেনিয়াল কোচ'৷ এমনই একজন হলেন মেগান অ্যাবট৷ তাঁর মতে, 'প্রবীণরা কঠোর পরিশ্রমকেই তুলে ধরতে চান ওয়ার্ক এথিক হিসেবে৷ পাশাপাশি নবীনেরা কাজকে ততোটুকুই গুরুত্ব দেন তার ফল কী বা কতোটুকু হবে সেটা ভেবে৷ তাঁরা দেখতে চান তাঁদের পরিশ্রমের সরাসরি কী প্রতিদান তাঁরা পাচ্ছেন৷'
এই সংঘাতের ফলে প্রবীণদের কি একেবারে বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে? না৷ বরং তাদের বানিয়ে ফেলা হচ্ছে নবীনদের মেন্টর৷ সরাসরি কাজের মধ্যে থাকতে হচ্ছে না আর প্রবীণদের৷ এবং লক্ষ্য করা গিয়েছে এই নতুন ভূমিকায় প্রবীণরা বেশ খুশি এবং নবীনরাও প্রবীণদের এই ভূমিকা হাসিমুখে মেনে নিচ্ছেন৷
কেমন চেহারা হবে ভবিষ্যতের অফিসের
Reviewed by Thailand Life
on
11:09 PM
Rating:
No comments: